সঞ্জিত সেন, পূর্ব বর্ধমান, ইন্ডিয়া নিউজ বাংলা : বর্ধমান পৌরসভা এলাকায় বহুতল নির্মাণ সংক্রান্ত অডিট রিপোর্টে প্রায় ২৩ কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই তুমুল আলোড়ন পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। ঘটনা জানার পর তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিরোধী দল। কলকাতা পৌরসভার নির্বাচন শেষ হতেই শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্যের বাকি পৌরসভাগুলির নির্বাচনের প্রস্তুতি। তার আগে বর্ধমান পৌরসভার শপিং কমপ্লেক্স ও আবাসন তৈরি সংক্রান্ত অডিট রিপোর্টে ফাঁস হল প্রায় ২৩ কোটি টাকার কেলঙ্কারি। এছাড়াও অন্য আরও একটি অডিট রিপোর্টে ফাঁস হয়েছে ৪১.৩৯ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ২০১৮ সাল থেকে বেআইনিভাবে ১০টি বহুতল নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়েছে বর্ধমান পৌরসভা।
ওয়েস্ট বেঙ্গল লোকাল অডিট ডিপার্টমেন্ট দুটি অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে (Corruption in multi-storey construction in Burdwan municipality)
রাজ্যের প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল (ওয়েস্ট বেঙ্গল লোকাল অডিট ডিপার্টমেন্ট) সম্প্রতি বর্ধমান পৌরসভা নিয়ে করা তাদের দুটি অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে। রিপোর্টের কপি বর্ধমান পৌরসভাতেও জমা পড়েছে। যদিও কারা পৌরসভা পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে এই আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল তা অডিট রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়নি।
একটি অডিট রিপোর্টে উল্লেখ কর হয়েছে, শহর বর্ধমানের ‘গোদা’ মৌজার ৩.৪২ একর অর্থাৎ ৩৪২ শতক জমিটি বর্ধমান পৌরভার। ২০০৬ সালে পৌরসভা পিপিপি মডেলে (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনার শিপ)ওই জমিতে শপিং কমপ্লেক্স ও রেসিডেনসিয়াল কমপ্লেক্স (আবাসন) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে টেন্ডার ডাকে। সেই টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজের বরাত পায় ‘আরডিবি রিয়েলিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটিড’ নামে একটি সংস্থা। প্রকল্পের কাজ নিয়ে ২০০৭ সালে এই সংস্থার সঙ্গে বর্ধমান পৌরসভার ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়। ‘মউ’ অনুযায়ী ঠিক হয় বর্ধমান পৌরসভাকে ১৬ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা দিতে হবে ওই সংস্থাকে। সেই মতো প্রথমেই ওই সংস্থা ‘চেকের’ মাধ্যমে ২ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা বর্ধমান পৌরসভায় জমা দেয়। বাকি ১৪ কোটি টাকা (প্রিমিয়াম মানি) ৬টি কিস্তিতে ওই সংস্থাকে বর্ধমান পৌরসভাকে মিটিয়ে দিতে হবে বলে ‘মউ’ চুক্তিতে উল্লেখ থাকে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘মউ’ চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয় ‘গোদা’ মৌজার ওই জমিতে বেসমেন্ট-সহ ৬ তলার একটি শপিং কমপ্লেক্স ও বেসমেন্ট-সহ ৮ তলার ৪টি রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি হবে। সেই মতো পৌরসভা থেকে প্ল্যানও পাস হয়। প্ল্যান অনুযায়ী কাজও শুরু হয়। তারই মধ্যে পৌরসভার পাওনা ১৪ কোটি টাকা মিটিয়ে দেয় ‘আরডিবি রিয়েলিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারপরেই ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই সংস্থাটি বিল্ডিংয়ের হাইট এক্সটেনশনের জন্য বর্ধমান পৌরসভায় আবেদন করে। অভিযোগ ‘মউ’ চুক্তির শর্ত দূরে সরিয়ে রেখে বকলমে সংস্থাটিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়।
‘প্রিমিয়াম অর্থ’ জমা না পড়ায় পৌরসভা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত (Corruption in multi-storey construction in Burdwan municipality)
সেই সুবিধা পাওয়ার দৌলতেই সংস্থাটি বেসমেন্ট-সহ ৮ তলা রেসিডেনসিয়াল কমপ্লেক্স তৈরির পরবর্তে করে নেয় বেসমেন্ট-সহ ১২ তলার ৪টি রেসিডেনসিয়াল কমপ্লেক্স। অর্থাৎ ভিতরে ভিতরে ‘সেটিং’ করে নিয়ে ওই সংস্থাটি অতিরিক্ত ১ লক্ষ ১ হাজার ৭৯০ স্কোয়ার ফিটের বিল্ডিং তৈরি করে নেয়। বিল্ডিংয়ের এই ‘হাইট এক্সটেনশন’ সংক্রান্ত কোনও নথি বা বোর্ড অফ কাউন্সিলার্সদের করা কোনও রেজিলিউশন কপিও অডিটররা পৌরসভায় পাননি। অডিট রিপোর্টে এও উল্লেখ করা হয়েছে বিল্ডিংয়ের হাইট এক্সটেশন করে নিয়ে সংস্থাটি বর্তমান বাজার মূল্য মোতাবেক ২২ কোটি ৯০ লক্ষ ২৮ হাজার ২৮৭ টাকা মুনাফা করে নেয়। কিন্তু হাইট এক্সটেনশনের দরুণ বর্ধমান পৌরসভায় কোনও ‘প্রিমিয়াম অর্থ’ জমা না পড়ায় পৌরসভা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একই অডিট রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ওই শপিং কমপ্লেক্স ও রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স ছাড়াও পৌরসভা ‘৫৯৯ মেমোতে’ অপর অারও একটি হাইরাইজ বিল্ডিং স্যাংশন করেছিল। তার কোনও নথির হদিশ যদিও পৌরসভায় পাননি অডিটাররা। অর্থপ্রাপ্তি থেকে পৌরসভাকে বঞ্চিত করে কারা, কী উদ্দেশ্যে একটি বেসরকারি সংস্থাকে এই আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দিল সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
অপর অডিট রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে বর্ধমান পৌরসভা বেআইনি ভাবে ১০টি বহুতল (হাইরাইজ বিল্ডিং) নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়ে ৪১.৩৯ লক্ষ টাকা নিয়েছে। যদিও ওইসব বিল্ডিংয়ের ‘প্ল্যান পাসে’ নেই পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ারের কোনও রিপোর্ট। সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লেভেল থেকেও ওইসব বিল্ডিংয়ের প্ল্যান ভেটেড করা হয়নি। বহুতল তৈরি হলেও পৌরসভার নথিতে তার ‘স্ট্রাকচারাল স্টেবিলিটি সার্টিফিকেটও’ পাওয়া যায়নি। এমনকী এই ক্ষেত্রে ‘ওয়েস্টবেঙ্গল বিল্ডিং রুল ২০০৭’-কে মান্যতাও দেওয়া হয়নি বলে অডিটাররা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।
‘ওয়েস্টবেঙ্গল বিল্ডিং রুল ২০০৭’-কে মান্যতা দেওয়া হয়নি (Corruption in multi-storey construction in Burdwan municipality)
এই বিষয়ে বর্ধমান পৌরসভার উপ-প্রশাসক আইনুল হক বলেন, ‘অডিট রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। রিপোর্টের আইনগত বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র দেবু টুডু ‘বিষয়টি দল দেখছে’ বলে এড়িয়ে যান। বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন, ‘পৌর নির্বাচনে আমরা এই ইস্যুকেই হাতিয়ার করব।’ নির্মাণকারী সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রদীপ কুমার পাগুলিয়া বলেন, ‘তাদের কোনও গরমিল নেই। তারা নিয়ম ও কাগজ মেনেই কাজ করছেন।’
———–
Published by Subhasish Mandal