কৌশিক বোস, দুর্গাপুর, ইন্ডিয়া নিউজ বাংলা: Chhau Dance in Durgapur ছৌ শিল্পী তৈরি করাই নেশা দুর্গাপুরের উখড়ার যুবক ‘ওস্তাদ’ তকমা পাওয়া অর্চিস্মান পালের। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি খুঁজে বেড়ান ‘ডানপিটে’ ছেলেমেয়েদের। যাঁরা গ্রীষ্মের চড়া রোদ মাথায় নিয়ে গ্রামের অলিগলি টো-টো করে ঘুরে বেড়িয়ে রোদ হজম করতে সক্ষম। পুকুরের জলে সাঁতার থেকে লাফঝাঁপ ও ভল্ট দিতে পারদর্শী। যাঁরা তরতরিয়ে নারকেল থেকে তাল গাছ-সহ লোকের বাড়ির আম-জাম-পেয়ারার গাছে উঠে ফল চুরি করতে সিধ্বহস্ত। কিতকিত, ল্যাংচা, লাল লাঠি-সহ কবাডি খেলাধূলায় শারীরিক কসরতে শৌর্যশালী সেই ‘ডানপিটে’ ছেলেমেয়েরাই তাঁর যুদ্ধনৃত্য তথা ছৌ নৃত্যের উপযুক্ত শিল্পী।
ইতিমধ্যেই তিনি প্রায় ৫০ জন ‘ডানপিটে’ ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছৌ নৃত্যের দল তৈরি করে সাফল্য লাভ করেছেন। এই দল রাজ্যের বিভিন্ন জেলা-সহ ভিন রাজ্যে ছৌ নৃত্য প্রদর্শন করে দর্শকদের মুগ্ধ করছে। মুখোশধারী ওই ‘ডানপিটে’ খুদে শিল্পীর দল প্রশংসিত হয়ে বর্তমানে জীবনমুখী রসদ খুঁজে পেয়েছে ছৌ নৃত্যে। বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ছৌ নৃত্য সংস্কৃতিকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ায় মূল উদ্দেশ্য বলে দাবি ওস্তাদ অর্চিস্মানের৷ Chhau Dance in Durgapur
প্রসঙ্গত, লোককাহিনী ও পুরাকথার আদিবাসী ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধের ভাণ্ডার আদিবাসী মুখোশ নৃত্য ‘ছৌ’। পুরুলিয়া জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের এই নৃত্য বিশ্ব বিখ্যাত। আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তর-সহ আন্তর্জাতিক স্তরে ছৌ নৃত্য প্রদর্শনীতে খ্যাতিলাভ করেছে। ভারতীয় দেবদেবী, দৈত্য-রাক্ষস এবং বাঘ, ভাল্লুক ও বানর, পাখি-সহ বিভিন্ন জীবজন্তুর আদলে মুখোশ পরে নৃত্য প্রদর্শন করেন শিল্পীরা। শিল্পীরা চরিত্রগুলির অনুরূপ মুখোশ পরিধান করে গান ও বাজনার তালে শারীরিক কসরতের মধ্যে দিয়ে এই নৃত্যের প্রদর্শন করেন। পুরুলিয়ার বাসিন্দা ছৌ নৃত্যশিল্পী গম্ভীর সিং মুড়া ভারত সরকার দ্বারা পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন ৮০ দশকে। ছৌ নৃত্যের জন্য পুরুলিয়া জেলা দেশজুড়ে বিখ্যাত হয়েছে।
দুর্গাপুরের অণ্ডাল থানার উখড়ার বাসিন্দা অর্চিস্মান পাল কলাবিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বিভিন্ন রকম ‘চামড়ার বাদ্যযন্ত্র’র প্রতি ছোট থেকে আকৃষ্ট হওয়ায় বর্তমানে তিনি একজন পেশাদার বাদ্যশিল্পী৷ তিনি ২০১৭ সালে সপরিবারে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে ছৌ নৃত্য দেখে তিনি ওই নৃত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন। তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে ছৌ নৃত্য ও গান-সহ বাদ্যযন্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। বছর না ঘুরতেই নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় ঐতিহ্যবাহী ওই নৃত্য-সহ গান ও বাজনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের ছৌ নৃত্যের দল তৈরি করতে উদ্যোগী হন। দল গড়তে শুরু করেন গ্রামের ‘ডানপিটে’ ছেলেমেয়েদের খোঁজ। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করতেই সাফল্য প্রকাশ পায়। স্বপ্নপূরণ হতেই তাঁদের নিয়ে শুরু করেন বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠান। Chhau Dance in Durgapur
ওস্তাদ অর্চিস্মান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে প্রকৃতির সাথে মিশে কঠোর পরিশ্রম করা মানুষের পক্ষেই সম্ভব এই ছৌ যুদ্ধনৃত্য। স্বপ্ন ছিল ওই নৃত্যে দক্ষ হওয়া ও একটি দল গঠন করার। কিন্তু এখানে তো রয়েছে ক্লাসিক্যাল ড্যান্স, কত্থক ও ভারতনাট্যম শেখার ছেলেমেয়েরা। এই ভেবে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পথেই এলাকার পুকুরের জলে একদল ‘ডানপিটে’ ছেলের স্নান করার ভঙ্গিমা স্বপ্নপূরণের আশা দেখাল৷ তাঁরা সকলেই প্রায় দুঃস্থ পরিবারের। তাঁদের পক্ষে কত্থক, ভারতনাট্যম শেখা দুষ্কর হলেও তাঁদের ডানপিটেপনার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ছৌ নৃত্যের প্রতিভা। অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয় তাঁদের। সেখানে ছৌ নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিতেই তাঁদের নৃত্যকুশলতায় সাফল্যের দিশা মিলল। আমি নিজেই মাটি ও কাগজের মণ্ড দিয়ে ছৌ নৃত্যের মুখোশ তৈরি করা শুরু করি এবং মানুষের বোঝার সুবিধার্থে পুরুলিয়ার আদি ভাষার ছৌ নৃত্যের গানের সাথে কিছুটা বাংলা ভাষা যোগ করে নিজেই নৃত্যের গানগুলি তৈরি করি। পাশাপাশি ধামসা, মাদল, ঢোল ও পুরুলিয়ার পাতার বাঁশির বদলে ক্যাজু নামের বাঁশি বাজিয়ে ছৌ নৃত্য সম্পূর্ণ করে থাকি। Chhau Dance in Durgapur
তিনি আরও বলেন, বহু প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নিজের পড়াশুনা ও বাজনার পাশাপাশি অদম্য প্রচেষ্টায় এই এলাকা ছৌ নৃত্যের অনুকূল করে তুলেছি৷ বর্তমানে প্রায় ৫০ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার দল। আর দল গড়ে উঠেছে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তাঁরা অধিকাংশ দুঃস্থ পরিবারের। বিনামূল্যে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিল্পী তৈরি করেছি৷ গত চার বছরে কলকাতা-সহ রাজ্যের ও বিহার-ঝাড়খণ্ডে প্রায় ৫০টির অধিক সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠান করেছি তাঁদের নিয়ে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁদের অর্থ উপার্জনও হয়েছে। ছৌ নৃত্যের মহিষাসুরমর্দিনী পালাটি বিশেষ আকর্ষণীয়। আমার দক্ষতার প্রশংসা করে পদ্মশ্রী প্রাপ্ত গম্ভীর সিং মুড়া মহাশয়ের পুত্র পরশুরাম সিং মুড়া চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি আমাকে মেমেন্টো দিয়ে ছৌ নৃত্যের ওস্তাদ তকমা দিয়েছেন। আমি গর্বিত। আগামী দিনে এই নৃত্যকে ছড়িয়ে দিতে ছৌ নৃত্য নিয়ে গবেষণাও করছি৷
খুদে শিল্পীরা প্রায় সকলেই অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। খুদে শিল্পী প্রদীপ রুইদাস, প্রেম বাদ্যকর, পাপ্পু দাস, নুপুর বাউরি, সোমা রুইদাসরা বলেন, আমরা কখনও ভাবিনি আমাদের খেলাধূলা আমাদের শিল্পী করে তুলবে। আমাদের ওস্তাদ আমাদের মধ্যে শিল্পীসত্বা খুঁজে পেয়েছিলেন। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দর্শকেরা যখন আমাদের প্রশংসা করে আমরা খুব খুশি হই। শিল্পী প্রদীপ রুইদাসের মা জুলি রুইদাস বলেন, আমি লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করি। আমার স্বামী রাজমিস্ত্রি। বাড়িতে কেউ না থাকায় ছেলে রাতদিন ডানপিটে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াত। আর এখন সবাই তাঁর প্রশংসা করে ছৌ শিল্পী বলে। ছৌ নৃত্যের পাশাপাশি পড়াশোনাতেও মন দিয়েছে।
Chhau Dance in Durgapur
————
Published by Subhasish Mandal